পোপ ফ্রান্সিস: এক অনন্য ব্যক্তিত্ব
পোপ ফ্রান্সিস, যিনি জর্জ মারিও বার্গোগলিও নামে জন্মগ্রহণ করেন (১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬ - ২১ এপ্রিল ২০২৫), ছিলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের ২৬৬তম পোপ এবং ভ্যাটিকান সিটি রাজ্যের সার্বভৌম। তিনি জেসুইট অর্ডারের প্রথম পোপ হিসেবে, দক্ষিণ আমেরিকা এবং দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে প্রথম পোপ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।
২০১৩ সালে পোপ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই তিনি ঐতিহ্যগত প্রথা ভেঙে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেন, যা তাকে 'জনতার পোপ' হিসেবে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ভ্যাটিকান সূত্র অনুযায়ী, তিনি সোমবার (২১ এপ্রিল, ২০২৫) সকাল ৭:৩৫ মিনিটে স্ট্রোক এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার ভ্যাটিকান বাসভবন কাসা সান্তা মার্তায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পোপ ফ্রান্সিসের বেতন ও আর্থিক সম্পদ
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনে অর্থের প্রতি তার উদাসীনতা ছিল অভূতপূর্ব। যদিও পোপের মাসিক বেতন ছিল ৩২,০০০ ডলার (বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২৭ লক্ষ টাকা), তিনি তার পুরো কার্যকাল জুড়ে একটি টাকাও নিজের জন্য গ্রহণ করেননি। সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থ অনুসারে, মৃত্যুর সময় তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০০ ডলার, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮,৫৩৬ টাকা এবং বাংলাদেশী টাকায় এর মূল্য আরও কম।
ভ্যাটিকান সূত্র থেকে জানা যায়, তার বেতনের সমগ্র অংশ বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অসহায় মানুষের চিকিৎসা ও কল্যাণে দান করে দেওয়া হত। তিনি তার জীবদ্দশায়ও এটি নিশ্চিত করেছিলেন যে, চার্চের কাজে এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সাহায্য করতে তার সম্পদ ব্যবহৃত হবে।
"ঈশ্বরের সন্তানেরা সেবা করতে এসেছে, সম্পদ জমাতে নয়" - এই নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
সাদামাটা জীবনযাপন ও বিনয়ী মনোভাব
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনযাপনের সাদামাটা স্টাইল তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছিল। পোপ হওয়ার পরও তিনি ভ্যাটিকানের বিলাসবহুল পোপীয় অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস না করে, অতিথি ভবন সান্তা মার্তায় এক ছোট কক্ষে থাকতেন। তার এই বিনম্র জীবনযাপনের শৈলী সমগ্র বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
পোপ ফ্রান্সিস পাঁচটি সরকারি গাড়ি, ভ্যাটিকান থেকে দেওয়া বাসস্থানসহ বিভিন্ন সুবিধা পেলেও, ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোনো সম্পত্তি সঞ্চয় করেননি। বরং তার ব্যবহারিক চাহিদা ছিল অত্যন্ত সীমিত, যা তার ব্যক্তিত্বের সাদামাটা দিকটিকে প্রকাশ করত।
সমাজের প্রান্তিক মানুষের পাশে ফ্রান্সিস
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এমন একজন ধর্মীয় নেতা, যিনি যত না পদমর্যাদার প্রতি মনোযোগী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন মানবতার প্রতি সংবেদনশীল। তিনি দরিদ্র, নিপীড়িত, অভিবাসী, বন্দী, হোমলেস এবং সমাজের হাশিয়ে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার বাণী ছিল - "যারা কণ্ঠহীন, তাদের কণ্ঠস্বর হওয়া উচিত আমাদের।"
তিনি নিজের থেকে অন্যের প্রয়োজনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণকারী এই পোপ বিশ্বাস করতেন "দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, আমরা ঈশ্বরের মুখোমুখি দাঁড়াই।" এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মৃত্যুর পর: মাত্র ১০০ ডলার সম্পত্তি
পৃথিবীর অন্যতম ধনী ধর্মীয় সংগঠনের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও, পোপ ফ্রান্সিস তার মৃত্যুর পর মাত্র ১০০ ডলার সম্পত্তি রেখে গেছেন। সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, "কণ্ঠহীনদের জন্য দাঁড়ানো এবং বিনয়ী জীবনযাপনের জন্য পরিচিত, পোপ ফ্রান্সিস মাত্র $100 ডলারের পিতৃত্বের সাথে তার জীবন শেষ করেছিলেন।"
যখন পোপ পদে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার অনুমানিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ মিলিয়ন ডলার, যা পদমর্যাদার সাথে সম্পর্কিত ছিল, কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে তা ব্যবহার করেননি। বরং সমস্ত অর্থ দাতব্য কাজে এবং মানবকল্যাণে নিয়োজিত করেছিলেন।
পোপ ফ্রান্সিসের উত্তরাধিকার ও প্রভাব
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ব শোকাহত। তার উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি রেখে গেছেন সমাজের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এবং সাদামাটা জীবনযাপন করার আদর্শ। তিনি চার্চকে আরও প্রগতিশীল করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা আগামী দিনেও ক্যাথলিক চার্চকে প্রভাবিত করতে থাকবে।
তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়েছিলেন এবং প্রায় চার লাখের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। প্রয়াত পোপের ইচ্ছানুযায়ী, তাকে একশ বছরেরও বেশি সময় পর ভ্যাটিকানের বাইরে, রোমের সান্তা মারিয়া মেজোরে ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হয়েছে, যেখানে তার সমাধি সাদামাটা রাখা হয়েছে।
উপসংহার:
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি শনিবার ধর্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে তার বিশাল বেতন (মাসিক ২৭ লক্ষ টাকা) থেকে এক টাকাও নিজের জন্য নেননি এবং সমস্ত অর্থ উদ্ধার করে দরিদ্র মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। তার মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া মাত্র ১০০ ডলার সম্পত্তি তার জীবনযাপনের নিরাসক্ত, সাদামাটা ও সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেয়।
"আমাদের নিজেদের সাথে নিতে পারব না, এমন জিনিসের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার কোনো অর্থ নেই" - পোপ ফ্রান্সিসের এই বাণী তার জীবনের মূলমন্ত্র ছিল, যা সারা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং করতে থাকবে।
শেয়ার: পোপ ফ্রান্সিসের জীবন কাহিনী থেকে আমরা সকলে অনুপ্রেরণা পেতে পারি। আপনার বন্ধুদের ও পরিবারের সাথে এই লেখাটি শেয়ার করুন এবং মন্তব্য বিভাগে জানান, তার জীবনের কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে।
সম্পর্কিত নিবন্ধসমূহ:
-
পোপ ফ্রান্সিসের জীবনী: আর্জেন্টিনা থেকে ভ্যাটিকান পর্যন্ত যাত্রা
ক্যাথলিক চার্চের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় পোপ: ফ্রান্সিসের বিশেষ অবদান
সরলতা ও বিনয়ের প্রতীক: পোপ ফ্রান্সিসের অসাধারণ জীবনযাপন
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে পোপ ফ্রান্সিস: মানবতার জয়গান